রাজু আহমেদ,বিশেষ প্রতিবেদক:
মাত্র ২০ হাত প্রশস্ত একটি খাল পারাপারে টানা দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে হাজার হাজার জনসাধারণের একটি নৌকাই ভরসা। আর দীর্ঘ এসময় ধরে একটি নৌকা ব্যবহার করেই যাত্রী পারাপারের ভাড়ার নামে বছরে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছে একটি প্রভাবশালী মহল। তবে এলাকাবাসীর জোরদাবি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুনজরদারির পাশাপাশি এই খালটিতে একটি কালভার্ট নির্মাণ করা হলে হাজারো মানুষের ভোগান্তির অবসান হবে।
দেশের মফস্বলের অবহেলিত কোনো অজপাড়া-গাঁয়ের দৃশ্য নয় বরং খোদ রাজধানীর মিরপুরের জনবহুল দারুসসালাম এলাকার জনদূর্ভোগের চিত্র এটি। আর এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই যুগে ওই স্থানটির নামকরন হয়েছে ‘হাক্কার পাড়’।
হ্যা। রাজধানীর মিরপুরে মাত্র ২০ হাত প্রশস্ত একটি খাল পারাপারে একটি নৌকা ব্যবহার করেই প্রতিদিন গড়ে ৪/৫ হাজার পথচারীদের নিকট থেকে প্রতিবার পারাপারে ভাড়া আদায়ের নামে ৫ টাকা হারে প্রতি মাসে ৮ থেকে ১২ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় করছে একটি প্রভাবশালী মহল। বছরে যে চাঁদার পরিমান গিয়ে দাড়ায় প্রায় এক থেকে দেড় কোটি টাকায়।
স্থানীয় ভুক্তভোগীদের দাবি, জনসেবার নামে চরম জনদূর্ভোগ সৃষ্টিসহ বছরে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও জন প্রতিনিধিগণ পরিপূর্ণভাবে অবগত থাকলেও দীর্ঘ দুই যুগেও এসমস্যা নিরসনে কোনো ভুমিকা রাখেননি তারা। আসলে এসমস্যা জিইয়ে রাখার পেছনের কারন হচ্ছে প্রতিমাসে চাঁদা হিসেবে ৮/১২ লক্ষ টাকা হারে গড়ে প্রতি বছরে আদায়কৃত ১ থেকে দেড় কোটি টাকা। যেটি ভাগাভাগি হয়ে সময়মত বিভিন্ন হাত ঘুরে পৌছে যায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহল,প্রশাসন ও জন প্রতিনিধিদের হাতে।
রাজধানীর মিরপুর,কল্যানপুর,শ্যামলীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দারুসসালাম ও মুনসুরাবাদ হয়ে গৈদারটেক,মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতে প্রতিদিন গড়ে ৫/৬ হাজার পথচারীদের মাত্র ২০ হাত একটি খাল পেরুতে ২০ থেকে ২৫ বছর যাবৎ একটি নৌকাই ভরসা। যার মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার গার্মেন্টস শ্রমিক রয়েছেন-যাদেরকে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াতে সকাল-বিকাল বাধ্যতামুলক খেয়া পারাপার হতে দিনে দুই বার পাঁচ টাকা হারে নৌকা ভাড়ার নামে চাঁদা প্রদান করতে হয়।
এদিকে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকারী খালগুলো রক্ষা ও সংরক্ষণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। মশক নিধনেও কোটি কোটি টাকা বাজেট ব্যয় করছে দুই সিটি করপোরেশন। পক্ষান্তরে সিটি কর্পোরেশনের প্রতিনিধিদের সহযোগীতায়ই খালগুলো বেদখল হয়ে থাকার অভিযোগও নতুন নয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে,দারুসসালাম মসজিদ থেকে সোসাইটি গেট হয়ে ডিএনসিসির আওতাভুক্ত সাধারণ ওয়ার্ড ৯,১০,১১ ও সংরক্ষিত -৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজিয়া সুলতানা ইতির বাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলেই সামনে পড়ল ‘হাক্কার পাড়’। নৌকাটির অপর পার্শ্বে তাকাতেই দেখা গেলো সরকারী খালের ওপরে বাঁশের মাচান করে শতাধিক রিক্সা রাখা হয়েছে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দারা ও রিক্সামালিকগণ জানান, এখানে একটি রিকসা রাখতে এক রাতের জন্যে রিক্সামালিকদের গুনতে হয় রিক্সাপ্রতি ৫০ টাকা। আর এই এলাকার আশপাশে এরকম প্রায় ৩০/৪০ টি গ্যারেজ রয়েছে। আর এই নৌকা ভাড়ার নামে আদায়কৃত বিপুল পরিমান চাঁদার টাকাসহ রিক্সার গ্যারেজগুলো থেকে আদায়কৃত এই মোটা অংকের অর্থ হাত ঘুরে মুকুট মাতবরের মাধ্যমে স্থানীয় কাউন্সিলর রাজিয়া সুলতানা ইতির স্বামী সোহরাব মাতবর ও তার ভাই আসাদুল্লাহ মাদবরের হাতে পৌছে যায়।
এপ্রসঙ্গে শাহাবুদ্দিন মিয়া নামে এই নৌকার মাঝি বলেন,আমরা প্রতিদিন লোক পারাপার করে পাঁচ টাকা হারে ভাড়া হিসেবে যে টাকা আদায় করি তার মধ্য থেকে আমাদের প্রতিদিনের হাজিরা রেখে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসায় দেই। স্থানীয় নেতাকর্মীদেরকে দিতে হয় না।
মুঠোফোনে ফোন করে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে ডিএনসিসির সংরক্ষিত -৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজিয়া সুলতানা ইতি বিষয়টি প্রথমে কৌশলে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে ডিএনসিসির ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবু তাহের ও আদাবর থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির নাম উল্লেখ করে জাগোকণ্ঠকে বলেন, এধরনের কোনো ঘটনার সাথে আমি,আমার স্বামী কিংবা আমার পরিবারের কেউ জড়িত নই। আর থাকলেও এটি আমার একার বিষয় নয়। ডিএনসিসির ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবু তাহেরের সাথে কথা বলতে হবে। আমার এলাকা নৌকার এই পাড়। আর ওই পাড়েরটা খায় আদাবরের সভাপতি-সেক্রেটারি। প্রয়োজনে আপনারা আবার আসেন, আমি সরেজমিনে যাবো। আমি বলতে চাই, আমাকে ও আমার পরিবারকে হেয়-প্রতিপন্ন করতে এধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তাছাড়া জনদূর্ভোগ নিরসনে আমি এখানে একটি কালভার্ট নির্মানে কর্তৃপক্ষের বরাবর বার বার আবেদন করে যাচ্ছি। আশা করি খুব শিঘ্রই এই খালে একটি কালভার্ট নির্মানের ব্যবস্থা করা হবে। তাহলে এই জনদূর্ভোগ লাঘব হবে বলে আমি আশাবাদ ব্যাক্ত করছি।
তবে ‘আপনি ডিএনসিসির দুই দুই বারের কাউন্সিলর হিসেবে ১৫ বছরেও এসমস্যার সমাধান করতে পারলেন না’ এমন প্রশ্নে বিব্রত হয়ে পড়েন তিনি। একসময় আমার অফিসে আসেন বলেই মুঠোফোনের লাইনটি কেটে দেন তিনি।
Leave a Reply