বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসাবে আবু সাদাত মোহাম্মদ (এ এস এম) সায়েমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি পদের শপথ গ্রহণ করেন। ওই সময় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল ঢাকা হাইকোর্ট। ১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হলে দেশে শুধু হাইকোর্টের পরিবর্তে সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৮ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ওই দিনই প্রথম কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৮ সাল থেকে দিনটিকে সুপ্রিমকোর্ট দিবস হিসেবে পালন করছে সর্বোচ্চ আদালত।
সে যাই হোক, মূল কথায় ফিরে আসি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ শপথ নেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ২৫ তম প্রধান বিচারপতি পেল। বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমের সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ না থাকার কারণে তিনি ঢাকা হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হন। তারপর থেকে ২৪ তম প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পর্যন্ত কেউই সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করেননি। তাঁরা সকলেই আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে এটাই সাধারণত রেওয়াজ যে আপিল বিভাগ থেকেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে কখনো কখনো প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন করা হয়েছে। সে বিষয় নিয়ে আরেকদিন লিখব। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, রেওয়াজ ভেঙে যে হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতিকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো এক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা একটু পরে জানব। তার আগে আমরা নিশ্চিত হব যে বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য কোনো আইন আছে কি না। সাধারণভাবে বললে না, নেই। ২০১০ সালে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি কতৃক জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জনস্বার্থে একটি রিট দাখিল করেন আইনজীবী হাসান এম এস আজিম। রিটে জ্যেষ্ঠতার নীতি লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ কেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী হবে না, সে মর্মে রুল চাওয়া হয়। হাইকোর্ট বেঞ্চ রিট আবেদনের ওপর কোনো রুল জারি না করলেও খুব গোপনে তিন-চার দিন ধরে শুনানি হয়েছিল। হাইকোর্ট জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণের আবেদন অগ্রাহ্য করেন। পরবর্তীতে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে, ২০১৫ সালের ৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ওই আপিল খারিজ করেন। উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হলাম যে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের জন্য আলাদা কোনো আইন নেই। যা আছে তা হল কনস্টিটিউশনাল কনভেনশন বা সাংবিধানিক রেওয়াজ।
এখন আমরা আমাদের প্রথম প্রশ্নে ফিরে আসি, একজন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিকে সরাসরি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি না। আমরা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছি যে, বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের জন্য সরাসরি কোনো আইন নেই তবে তবে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারক নিয়োগের জন্য আইন আছে। বিচারপতি নিয়োগ-সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন। (২) কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হইলে, এবং (ক) সুপ্রীম কোর্টে অন্যূন দশ বৎসরকাল অ্যাডভোকেট না থাকিয়া থাকিলে; অথবা খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বৎসর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করিয়া থাকিলে; অথবা (গ) সুপ্রীম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকিয়া থাকিলে; তিনি বিচারক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’
উপরিউক্ত অনুচ্ছেদের আলোকে বর্ণিত যোগ্যতা ও অযোগ্যতার নিরিখে যে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য। সেই যোগ্য বিচারকদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি তার সন্তুষ্টি সাপেক্ষে যেকোনো ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করতে পারেন। তাই এক্ষেত্রে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।
এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে অনেকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে তো রাষ্ট্রপতি তাঁর সন্তুষ্টি সাপেক্ষে নিয়োগ দেন নাই। বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাহলে এই নিয়োগ বৈধ হয় কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, যদিও সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছে কিন্তু বাস্তবে কখনোই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রধান বিচারপতির ফাইল না যেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যাই নাই। অর্থাৎ পূর্বেও প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। আমার এই বক্তব্যের পক্ষে প্রথম আলোর প্রয়াত সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের কাছে সাবেক তিন আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, মওদুদ আহমদ ও শফিক আহমেদ স্বীকার করেছেন যে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ফাইল রাষ্ট্রপতির কাছে যাওয়ার পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়। অর্থাৎ আগেও প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে নিয়োগ দিতে পারতেন না। বর্তমানে বাংলাদেশে ছাত্র জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা মূলত তাৃদেরই সরকার। তাই তাঁদের দাবিতে যদি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে তা কোনভাবেই অবৈধ হতে পারে না।
আপনাদের একটি চঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে এই লেখার যবনিকা টানছি। বর্তমান প্রধান বিচারপতির আগের দুজন প্রধান বিচারপতি, অর্থাৎ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের পরে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। বিচারবিভাগে তারা দুজনেই বর্তমান প্রধান বিচারপতির কর্মে জুনিয়র। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার সৈয়দ রেফাত আহমেদের উপর ন্যায় বিচার করেননি। শুধুমাত্র তিনি চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া বিচারক হওয়ার কারণে এতদিন তাঁকে আপিল বিভাগেও আনা হয়নি।
সদ্য সাবেক সরকারের আমলে বিচারবিভাগ কিভাবে পরিচালিত হতো সে বিষয়ে সামান্য ধারণার জন্য ওই সরকারেরই নিয়োগ পাওয়া দুজন প্রখ্যাত আইনজীবীর একটি জাতীয় পত্রিকার সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরছি। সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান বলেন, সরকারের কারণেই বিচার বিভাগের আজকের এই দুর্দশা। গত ১৪ বছরে যেসব বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে, তার বেশিরভাগই মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হয়েছে। ‘মেধার লোক’ না বসিয়ে ‘স্লোগানের লোক’কে বিচারপতি বানানো হয়েছে। আইনে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘনের (সুপারসিট) বাধা নেই। কিন্তু মেধাবী লোকজন থাকলে তাদের ক্ষেত্রে সুপারসিট করা ঠিক হয়নি। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হলে, সুপারসিট না করা হলে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের অনেক আগেই আপিল বিভাগে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ হওয়ায়, সেটা হয়নি। নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিলে তো বিচার বিভাগ শক্তিশালী হবে না। মানুষের মাঝে বিচার বিভাগ নিয়ে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেবে। সেজন্য বিচার বিভাগকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।’ উল্লেখ্য সিনিয়র আইনজীবী এম কে রহমান বর্তমান সরকারেরই নিয়োগ পাওয়া অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘১৪ বছর ধরে যেভাবে দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারই পরিণতি দেখতে পেয়েছে জাতি। যাকে সরকারের লোক মনে করা হয়েছে, যে কোনো পরিস্থিতিতে তারা সরকারের পাশে থাকবে, শুধু তাদেরই নিয়োগ করা হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক কারণে অনেক ভালো ভালো বিচারপতি, যেমন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি মো. ইমান আলীসহ অনেক দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি বানানো হয়নি। তারা প্রত্যেকেই সৎ, মেধাবী ও দক্ষ ছিলেন। সৎ, মেধাবী ও দক্ষতা অনুযায়ী নিয়োগ হলে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ অনেক আগেই প্রধান বিচারপতি হতেন। কিন্তু তা হয়নি।’
বিচারবিভাগের ইতিহাসে এমন অন্ধকার যুগ আর না আসুক, বিচার বিভাগ চলুক তার আপন মহিমায়। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সহায় হোন।
লেখক:
আরিফুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি)
Leave a Reply