শরীয়তপুরের বাসিন্দা জাফর হোসেন নয় লাখ টাকা দিয়ে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে রোমানিয়ায় গিয়েছিলেন এই বছরের শুরুতে। সেখানে তার মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ৬৫০ ইউরো, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। তিনি একটি প্যাকেজিং কোম্পানিতে চাকরি করেন।
তিনি বলছিলেন, “বাড়ির একটা জমি বিক্রির পরেও ধার দেনা করে রোমানিয়ায় এসেছিলাম। যে বেতনের কথা বলেছিল, তাতে দুই-আড়াই বছরে ধার শোধ হয়ে যেতো। কিন্তু এখনে এসে দেখি, বেতন ভাতা তার চেয়ে অনেক কম। কবে ধার শোধ করতে পারবো, কবে নিজের পায়ে একটু মাটি পাবো, জানি না।”
রোমানিয়ার জেনারেল ইনস্পেক্টরেট ফর ইমিগ্রেশন (আইজিআই) একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই বছরের প্রথম ছয় মাসে পাঁচ হাজার ৭৬৫ জন বিদেশি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছে, যাদের মধ্যে দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি রয়েছে।
গত আড়াই বছরে অনেকটা হঠাৎ করেই বাংলাদেশ থেকে রোমানিয়ায় যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
ঢাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন একটি ট্রাভেল এজেন্সিকে ছয় লাখ টাকা দিয়েছেন রোমানিয়ায় যাওয়ার জন্য। এখনো তার ভিসা হয়নি।
তিনি বলছেন, এর আগে একবার মালয়েশিয়া গিয়ে কিছুদিন কাজ করেছি। সেখানে সুবিধা হয়নি। আমাদের গ্রামের একজন রোমানিয়ায় গেছে। তার পরামর্শে আমিও যাওয়ার চেষ্টা করছি।‘’
তাকে ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বলা হয়েছে, বিমান টিকেটের বাইরে আরও কিছু টাকা দরকার হতে পারে।
কেন রোমানিয়া গন্তব্য হয়ে উঠছে?
রোমানিয়া হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ, যার আয়তন দুই লাখ ৩৮ হাজার ৩৯৭ বর্গকিলোমিটার। তবে দেশটির বাসিন্দা মাত্র এক কোটি ৮৯ লাখ। এর চারদিকে হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, সার্বিয়া, মলদোভার মতো দেশের সীমান্ত রয়েছে।
বিদেশে শ্রমিক বা শিক্ষার্থী পাঠানো নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন, তুলনামূলকভাবে ভিসা পাওয়া সহজ হওয়ার কারণে পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়ায় যাওয়া অনেকের কাছে পছন্দের দেশ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘’রোমানিয়ার বিভিন্ন কারখানায় কাজের জন্য শ্রমিকদের একটা চাহিদা আছে। গত বছর তাদের একটা টিম এসে বেশ কিছু বাংলাদেশিকে সরাসরি রিক্রুট করে নিয়ে গিয়েছিল।
“কিন্তু এখন সেখানে যাওয়ার হিড়িকের মূল কারণ হলো তারা ইউরোপে ঢুকতে চায়। ইউরোপের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে রোমানিয়ার ভিসা পাওয়া একটু সহজ, কারণ ওয়ার্ক পারমিট বা স্টুডেন্ট হলে ভিসা দিয়ে দিচ্ছে। যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, আমার ধারণা তাদের তথ্যের চেয়ে বেশি গিয়েছে। এরা সেখান থেকে হয়তো অন্য কোন দেশে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইটালি, পর্তুগাল, স্পেন ইত্যাদি দেশে চলে যাচ্ছে,” তিনি বলেন।
মনোয়ার হোসেন (ছদ্মনাম) কর্মী ভিসায় রোমানিয়া এসেছিলেন। কিন্তু কিন্তু ট্রাভেল কোম্পানি তাকে শর্ত দিয়েছিল, ওয়ার্ক ভিসায় রোমানিয়া পাঠাতে পারবে কিন্তু বাস্তবে চাকরির কোন ব্যবস্থা হবে না। রোমানিয়া যাওয়ার পর তিনি ইতালি চলে গেছেন, কারণ সেখানে তার আত্মীয়স্বজন আছে।
রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস যা বলছে
রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা শেখ কৌশিক ইকবাল বলেন, বাংলাদেশ থেকে গত বছর ২০ হাজারের বেশি মানুষ রোমানিয়ায় এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার ইমিগ্রেশন পরে পরীক্ষা করে দেখেছে, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই এখন রোমানিয়ায় নেই। ফলে তারা আগে ওয়ার্ক পারমিট দেখেই ভিসা দিলেও এখন অনেক যাচাই বাছাই শুরু করেছে। এ কারণে এ বছর ভিসার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। এরপরেও এখন রোমানিয়ায় আনুমানিক ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে বলে দূতাবাস ধারণা করছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে এখানে আসার অন্যতম একটি আকর্ষণ, তারা রোমানিয়াকে ইউরোপে ঢোকার একটি রুট হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু এখানেও অনেক ভালো কাজের ব্যবস্থা আছে। কারণ রোমানিয়ার অনেক মানুষ ইউরোপের অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে, ফলে এখানেও কর্মী সংকট আছে।
‘’কিন্তু দেখা গেছে, যারা লোক আনছে, তাদের লোক দরকার এখন, লোক আসছে হয়তো এক বছর পরে। আবার আসার পরে তারা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। ফলে রোমানিয়ার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি কর্মীদের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে,’’ বলছেন ইকবাল।
বাংলাদেশি কর্মীরা যাতে অন্য দেশে চলে না যায়, সেজন্য নানা রকম উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের উৎসাহিত করার জন্য দূতাবাস চেষ্টা করছে বলে তিনি জানান।
Leave a Reply