সাধারণত প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে “Constitutional law of UK and USA” নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কোর্সে ভারতের সংবিধানও পড়ানো হয়ে থাকে। এই কোর্সের ব্রিটিশ সংবিধান অংশ একটা বড়ই অদ্ভুত বিষয়, আমরা বলে থাকি ইংল্যান্ডে কোন লিখিত সংবিধান নেই, আবার ব্রিটিশ সংবিধানকে ক্লাসে কোর্স হিসেবে পড়াই। যাদের কোন লিখিত সংবিধানই নেই, তাদের সংবিধান আমরা কোর্স হিসেবে পড়ি। বড়ই অদ্ভুত বিষয়।
সাধারণত বাংলাদেশ সংবিধান পড়ার পরেই ছাত্রদের এই কোর্স পড়ানো হয় বলে তাদের শিক্ষকের কাছে প্রশ্নের শেষ থাকে না। তারা বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ সংবিধানকে রিলেট করে অনেক প্রশ্ন করে। আর এটাই স্বাভাবিক।
সেদিন ব্রিটিশ সংবিধানের আইনসভা (British Parliament) নিয়ে ক্লাসে লেকচার দিচ্ছিলাম। এখানে একটি বিষয় পড়াতে হয়, তাহলো ব্রিটিশ আইনসভা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। ব্রিটিশ আইনসভার উচ্চকক্ষের নাম হাউজ অফ লর্ডস আর নিম্নকক্ষের নাম হাউজ অফ কমন্স। এই বিষয়টি পড়াতে গেলেই অনেক ছাত্রের প্রশ্ন থাকে, স্যার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হলেও আমাদের বাংলাদেশের আইনসভা এক কক্ষ বিশিষ্ট কেনো? অথবা তারা আরো একটি প্রশ্ন করে, স্যার আইনসভা আবার দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হলো কি করে?
সত্য বলতে প্রথমদিকে এ বিষয়টি আমাকেও ভাবিয়েছে। চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করে যা পেলাম তার ফলাফল হচ্ছে এই। আধুনিক সভ্যতার আইন, বিচার ও সংসদীয় ব্যবস্থা রোমানদের নিকট পদে পদে ঋণী। বর্তমান বিশ্বের সুশৃঙ্খলিত আইন ব্যবস্থার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো দিনের নয়। অথচ আধুনিক সভ্যতার অনেক আগে, খ্রিষ্ট-পূর্ব ৭৫৩ অব্দে রোমানরা যে সুশৃঙ্খল আইন, বিচার ও সংসদীয় ব্যবস্থার প্রচলন করেছিল তা সে সময়ের জন্য ছিল সত্যিই এক মহাবিস্ময়। বর্তমান পৃথিবীতে এমন কোনো সভ্য জাতি নেই যাঁরা রোমানদের নিকট হতে আইন বিষয়ক কিছু না কিছু গ্রহণ করেনি। সে কারণেই আলোচনার শুরুতেই বলেছি, আধুনিক সভ্যতার আইন, বিচার ও সংসদীয় ব্যবস্থা রোমানদের নিকট পদে পদে ঋণী।
আজ আমরা আইন ও বিচার নয়, অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘সংসদীয় গণতন্ত্রে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা’ উদ্ভবের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো। আইনসভার ইতিহাস রোমানদের দিয়ে সূচিত হলেও তাঁদের আইনসভা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট ছিলো না। ইতিহাসের পরিক্রমায় রোমানদের কয়েক শ্রেণির আইনসভা থাকলেও তা ছিলো এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা। দ্বি-কক্ষীয় আইনসভার উদ্ভব হয়েছে রোমানদের থেকে দুই সহস্র বছরেরও বেশি সময় পরে বর্তমান ইংল্যান্ডে।
সময়টা ছিলো ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। ঐতিহাসিক ম্যাগনা কার্টা গৃহীত হওয়ার কিছুকাল পরে। রাজা তৃতীয় হেনরীর রাজত্বকালে হেনরীর সঙ্গে জমিদারদের বিরোধ বাধে। বিরোধের কারণ, ১২৫৪ সালে রাজা হেনরী নতুন করে কর ধার্য করেন। কিন্তু জমিদাররা হেনরীর এই উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করে। এই বিরোধে জমিদারদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সাইমন ডি মন্টফোর্ট। মন্টফোর্ট আন্দোলনে জয়ী হন এবং ১২৬৫ সালে পার্লামেন্টে একটি অধিবেশন আহবান করেন। এই অধিবেশনে জমিদার, যাজক এবং নাইট ছাড়াও প্রত্যেক শহর হতে দু’জন করে প্রতিনিধি আমন্ত্রন জানানো হয়। অনেকেই তাই সাইমন ডি মন্টফোর্টকে ব্রিটেনের আধুনিক সংসদীয় ব্যবস্থার জনক হিসেবে অভিহিত করেন। তবে যথার্থ বিচারে সেটি সংসদীয় অধিবেশন ছিলনা, ছিল একটি দলীয় সম্মেলন।
এরপরে রাজা হেনরীর পুত্র প্রথম এডওয়ার্ড যখন রাজা হন, তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে তাঁরও অধিক অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। এবার তিনি পিতার পথ অনুসরণ করলেন না। জোর করে কর চাপিয়ে না দিয়ে তিনি ১২৯৫ সালে পার্লামেন্টের এক অধিবেশন আহবান করেন। ঐ অধিবেশনে সকল শ্রেণির প্রতিনিধিদের আহবান করা হয়। দু’জন আর্চ বিশপ, আঠারোজন বিশপ, তিনজন যাজক, ছেষট্টিজন এ্যাবট,নয়জন আর্ল, একচল্লিশজন ব্যারন, একষট্টিজন নাইট এবং একশ বাহাত্তরজন শহরাঞ্চলের প্রতিনিধি এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। এই অধিবেশনকে ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘আদর্শ পার্লামেন্ট’ বলা হয়ে থাকে। ১২৯৫ সালের ঐ অধিবেশনের সদস্যগণ তিনটি স্বার্থগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলো।
তাঁরা হলেন-
(১) অভিজাত সম্প্রদায়,
(২) যাজক সম্প্রদায় এবং
(৩) সাধারণ মানুষ।
কালক্রমে অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ নিজেদের স্বার্থে একজোট বাধেন। তাঁরা একদিকে ভোট দিতেন এবং সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিগণ অন্যদিকে ভোট দিতেন। তিনটি সম্প্রদায় পরস্পর দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোট দেওয়ার কারণে পরবর্তীতে ব্রিটিশ আইনসভায় দু’টি কক্ষের উদ্ভব হয়। অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিপুষ্ট কক্ষটি লর্ড সভা এবং অন্যান্যদের কক্ষটি কমন্স সভা নামে পরিচিতি লাভ করে।
তবে মজার বিষয় হলো ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লর্ড সভা বা কমন্স সভা আলাদা করে সুপরিকল্পিতভাবে কেউ সৃষ্টি করেনি। সমকালীন সামাজিক গঠন বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড সভা ও কমন্স সভার উদ্ভব হয়েছে। এভাবেই আজকের সংসদীয় ব্যবস্থায় দ্বি-কক্ষীয় আইনসভার উদ্ভব ঘটে। পরবর্তীতে গণতন্ত্র চর্চায় সহায়ক হওয়ার কারণে ইংল্যান্ডে দ্বি-কক্ষীয় আইনসভা স্থায়ীরূপ লাভ করে। বর্তমানে বিশ্বের ৪৯ টি দেশে দ্বি-কক্ষীয় পদ্ধতির আইনসভা বিদ্যমান। অন্যান্য দেশে রয়েছে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা। তবে গণতন্ত্র চর্চায় দ্বি-কক্ষীয় আইনসভা বাধ্যতামূলক নয়। এটা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা। তাঁরা ইচ্ছা করলে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন আবার নাও করতে পারেন। সে কারণেই এখনও পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বিদ্যমান।
লেখক:
আরিফুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি (বিইউবিটি)
Leave a Reply