(তৃতীয় কিস্তি)
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক লাইফ শেষ করে, প্রায় আট বছরের আবাসিক হল ছেড়ে কুষ্টিয়া শহরের জেলখানা মোড়ের জিয়া মেসে আস্তানা গাড়লাম। চাকরির পড়াশোনা ও টিউশনি করে দিন কাটে। একদিন হাউজিং এর নিশান মোড় থেকে পাথেয় নামের একটি মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে মেসে যাচ্ছি। মাদকাসক্ত কেন্দ্রটির একটু দূর থেকেই লক্ষ্য করছি কেন্দ্রটির গেইটে দুজন মধ্য বয়সি লোক দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। যে কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করতেই পারেন তাতে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু তাদের একজনকে আমার পূর্ব পরিচিত মনে হল, মনে হলো তাকে আগে কখনো, কোথাও দেখেছি। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে মনে করতে পারছিলাম না কোথায় দেখেছি। ভদ্রলোক সুঠাম দেহের অধিকারী, কেতা দুরস্ত পোশাক, উজ্জ্বল ফর্সা চেহারায় মেহেদি করা পরিপাটি শ্মশ্রু, লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি হবেন। দেখেই সম্ভ্রান্ত মনে হয়। কাছাকাছি আসতেই চোখাচোখি হল। আমি সালাম দিলাম। ভদ্রলোক সালামের জবাব দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা কেমন আছো? ততক্ষণে আমার মনে পড়ে গেছে, ভদ্রলোক আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট ভাইয়ের পিতা। বছর দুয়েক আগে আমাদের আইন অনুষদ, মীর মশাররফ হোসেন একাডেমিক ভবনের সামনে জুলফিকার ভাইয়ের চায়ের দোকানে চা পান করতে করতে পরিচিত হয়েছিলাম। চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভদ্রলোক বলেছিলেন, তিনি যশোরের মানুষ। পেশায় ব্যবসায়ী। তাঁর থানার নাম শুধু ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে, স্বরবর্ণের কোনো কার নেই। জানালেন অভয়নগর। দুই সন্তানের জনক তিনি, মেয়ে বড়, আগেই সৎপাত্রে সমর্পণ করেছেন। ছেলের মা ছেলেকে যশোরের বাইরে পাঠাতে রাজি নন, তারপরেও ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে, পরে আফসোস করলেও এই সুযোগ আর আসবেনা তাই নিজেই জোর করে ছেলেকে এখানে ভর্তি করতে নিয়ে এসেছেন। এর পরে আর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কিন্তু এতদিন পরেও তিনি আমাকে মনে রেখেছেন। আমি মুগ্ধ হলাম।
কুশল বিনিময়ের পর, জিজ্ঞেস করলাম আঙ্কেল আপনি এখানে কেন? এরমধ্যে সাথের ভদ্রলোকটি সালাম দিয়ে বিদায় নিল। ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বললেন, বাবা আমার কপাল মন্দ। তা না হলে আমি এখানে থাকবো কেন? তার কথার অর্থ কিছুই বুঝতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আঙ্কেল কি হয়েছে, আমাকে কি বলা যাবে? ভদ্রলোক বললেন, তুমি তো বাবা আমার ছেলেকে চেনো? যাকে তোমাদের ওখানে ভর্তি করালাম। আমি বললাম জি আঙ্কেল, কিন্তু অনেকদিন হলোতো ওর সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।
ভদ্রলোক করুন ভাবে বললেন, দেখা হবে কি করে; কোনোভাবে প্রথম বর্ষটা শেষ করেছিল, এরপরেই আমার দুর্দিন শুরু। আমি বললাম, আঙ্কেল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না; আমাকে একটু খুলে বলুন। আমি তখনো বুঝতে পারিনি, পরক্ষণেই কি এক ভয়াবহ ঘটনা শুনতে যাচ্ছি এক অসহায় পিতার করুন কন্ঠে। ভদ্রলোক বললেন, ছেলেকে ভার্সিটিতে ভর্তি করে আমি নিজে এসে কুষ্টিয়ায় মেস ঠিক করে দিয়েছিলাম। লেখাপড়া ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পর, সে আমার ঠিক করে দেওয়া মেস ছেড়ে বন্ধুদের প্ররোচনায় অন্য মেসে চলে যায়। আমরা তা বুঝতে পারি নাই। প্রথম বর্ষটা মোটামুটি ভালোই কেটেছিল । এরপরই ছেলের আচরণে পরিবর্তন দেখতে পাই, ফোন দিলে ঠিক ভাবে ফোন ধরে না, মাঝে মাঝে মনে হয় কথাবার্তা অসংলগ্ন, মনে হচ্ছে ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়াও করে না, শরীরটা ও ভেঙে গেছে। তোমার চাচী তো ছেলের এই অবস্থা দেখে কেঁদে কেটে একাকার। ছেলেকে বাড়ি আসতে বললাম। বাড়িতেও ছেলের একই অবস্থা, কোনো পরিবর্তন নেই। আমরা নিশ্চিত হলাম, ছেলে নেশার ফাঁদে পড়েছে। পিতা হিসেবে নিজেকে লজ্জিত,অপমানিত ও অসহায়ত্ব বোধ করতে লাগলাম। প্রথমে স্বীকার না করলেও,পরে স্বীকার করতে বাধ্য হল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আজ ওর এই অবস্থা। একটি মাত্র ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, যখন যা চেয়েছে তাই দিয়েছি, কখনো কোনো কষ্টে রাখেনি। খাওয়া-থাকায় যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য পর্যাপ্ত টাকা দিয়েছি। কিন্তু তার ফলাফল হিসেবে আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমরা পরিবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি তাকে ভালোর পথে ফিরিয়ে আনতে কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছি। কয়েকদিন ভালো থাকে, আবার গোপনে মাদক গ্রহণ করে। বাধ্য হয়েই গত মাসে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করালাম। আমি এক অসহায় পিতার করুণ চাহনি অবলোকন করলাম। খুব কষ্ট হলো ভদ্রলোকের জন্য।
ভদ্রলোক যোগ করলেন, ছেলের কলেজ লাইফ পর্যন্ত তো আমার আয়ত্তেই ছিল। মেধাবী ছাত্র হিসেবে এলাকায় সুনাম ছিল ছেলের, কখনো এলাকার বখাটে ছেলেদের সাথে মেশার সুযোগ পায় নাই। এখানে এসে আমার হাতছাড়া হয়ে যায়, মিশে যায় মেসের বন্ধুদের সাথে। এবং সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু ও পরে যে মেসে যায় সেখানের দুইটা ছেলে ছিল নেশাগ্রস্ত, ওদের কারণেই আমার ছেলে নেশায় জড়িয়ে যায়। কথায় আছে না, “সঙ্গ দোষে, লোহা ভাসে।” সঙ্গ দোষে আমার ছেলেটা আজ নিঃশেষ হয়ে গেল। আমি ভদ্রলোককে সান্ত্বনা দেওয়ার দুঃসাহস করি নাই। কীভাবে যে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছিলাম, আমার কাছে আজও তা বিস্ময়। এরপরে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আর কখনো দেখাও হয়নি, কোনো যোগাযোগও হয়নি। ছেলেটি শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া সমাপ্ত করতে পেরেছে কি না আমার জানা নেই।
বর্ণিত ঘটনা ইহাই প্রমাণ করে যে, একটি অপার সম্ভাবনাময় তরুণ মন্দ বন্ধুত্বের সংস্পর্শে এসে অকালেই হারাতে পারে। পরিবারের স্বপ্নকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে। তাই আমার দৃষ্টিতে একজন আইনে পড়ুয়া নবীন শিক্ষার্থীদের বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক না থাকা একটি মারাত্মক ভুল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে অনেকেই পরিবারের আয়ত্তের বাইরে চলে যাই। শুরু হয় এক বাধাহীন জীবন, পিতা-মাতা বা পরিবারের সদস্যরা পাশে থাকে না বলে আমাদের ভুল শুধরে দেওয়ার কেউ থাকেনা। নিজেকেই নিজের অভিভাবক হতে হয়, আর এই সময়েই আমরা ভুলটি করে বসি। সময়ের ব্যবধানে এমন সব মানুষ আমাদের বন্ধু হয়ে ওঠে, যারা আসলে প্রকৃত বন্ধু নয়; জীবন ধ্বংসকারী শত্রু।
ঠিক এর বিপরীত চিত্রেরও অভাব নেই, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজারো স্বাপ্নিক তরুণ নতুন পরিবেশে এসে বন্ধুদের সহায়তায়ই নিজের জীবনকে বদলে নিয়েছেন। অর্থাৎ সিদ্ধান্তটা নিতে হবে আপনাকেই, আপনি কি মন্দ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নিজের জীবনকে রসাতলে ঠেলে দিবেন; না সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ভালো বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে নিজের জীবনকে বদলে দিবেন। একজন মানুষের সুন্দর জীবন বিনির্মাণে অনেকেরই ভূমিকা থাকে, তবে এক্ষেত্রে ভালো বন্ধুর ভূমিকা অপরিসীম। কারণ একজন বন্ধু আপনার সাথে যেভাবে মিশতে পারে, এটা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
জীবনে বন্ধুর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ভারতের প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ও সাবেক ১১তম রাষ্ট্রপতি এ.পি.জে আবদুল কালাম বলেছেন,
“একটি বই একশটি বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভালো বন্ধু পুরো একটি লাইব্রেরির সমান।”
একটি ভালো বই যেমন আপনাকে সুপথ দেখাতে পারে, ঠিক একজন ভালো বন্ধু আপনার জীবনকেও বদলে দিতে পারে। আপনার জীবনের লক্ষ্য ও চিন্তাধারা এবং আপনার বন্ধুদের জীবনের লক্ষ্য ও চিন্তাধারা যদি ভিন্ন হয় তাহলে আপনার সেই বন্ধু অচিরেই ত্যাগ করা উচিত। কারণ তাহলে আপনার সফলতা-ব্যর্থতা, অর্জন-বর্জন, উন্নতি-অবনতি, সফলতা ও ব্যর্থতা আপনার বন্ধুদের হৃদয়ে কখনোই কোনো প্রভাব বা আগ্রহের সৃষ্টি করবে না।
একটা ছোট্ট গল্প বলে আজকের লেখাটা শেষ করছি। গল্পটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল স্যারের ‘পিএইচডির গল্প’ বই থেকে নেওয়া। তিনি ১৯৮০ সালে ঢাকার ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। মানবিক বিভাগ থেকে তিনি ঢাকা বোর্ডে দশম স্ট্যান্ড করেন। ওই বয়সে যা হয় আরকি, পরীক্ষার ফলাফলের চেয়েও বিকেলে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলা অনেক বেশি আনন্দের মনে হয়। যথারীতি তিনি বিকালে বন্ধুদের সাথে মাঠে গেলেন। লেখক এর ভাষায় “বুড়িগঙ্গার বুক ঠেলে ওঠা কামরাঙ্গীরচরে তখনো মানুষের বসতি শুরু হয়নি সেভাবে। সেখানে খেলতে খেলতে চরের বন্ধুদের রেজাল্ট জানালাম। পড়াশোনা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাদের। ফলে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না।”
আপনি বিশ্বাস করুন, যারা আপনার সহপাঠী অথবা বন্ধু তারা প্রত্যেকেই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে লেখাপড়া করছে এমনটি মনে করার কারণ নেই। অনেকেই লেখাপড়া করে ঐচ্ছিক হিসেবে, একটা ডিগ্রি অর্জনের জন্য। একটা সার্টিফিকেট অর্জন হলেই তারা সফল। তাদের চিন্তা-চেতনায় গা ভাসিয়ে দিলে আপনি কখনোই সফল হতে পারবেন না। একজন নবীন আইনের শিক্ষার্থীকে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি দূরদর্শী হতে হবে, তা না হলেই বিপদ। (চলবে)
লেখক:
আরিফুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ;
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, (বিইউবিটি)।
Leave a Reply