বছর দেড়েক আগের ঘটনা। আমার এক ছাত্র মেসেজ করে আমার কাছে একটু দেখা করবার সময় চাইল। তার মেসেজের সারবস্তু হলো এই, সে ইতোমধ্যে কয়েকবার আমার সাথে দেখা করার জন্য আমার কনসাল্টেশন আওয়ারে (শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ আলোচনা ঘণ্টা) এসেছিল। কিন্তু আমি ফ্রি ছিলাম না, কেউ না কেউ আমার চেম্বারে ছিল। সে তার একটি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আমার সাথে অন্যের অগোচরে কথা বলতে চায়। সময় দিলে সে সেই সময় উপস্থিত হবে। মেসেজের শেষাংশে ছেলেটির নাম ও আইডি দেখে নিশ্চিত হলাম সে ফাইনাল সেমিস্টার এর ছাত্র, সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। আমার মনে পড়লো, করোনা মহামারি শুরুর আগে কয়েকদিন ওদের অন ক্যাম্পাস ক্লাস নিয়েছিলাম। করোনা শুরু হলে, অধিকাংশের মতো আমিও গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। এরপরে ওদের দু-একটা যা কোর্স পড়িয়েছি সবই অনলাইনে করোনার মধ্যে। করোনা পরবর্তীতে অন ক্যাম্পাস ক্লাস শুরু হলেও, তখন আর ওদের কোনো কোর্স পড়ানোর সুযোগ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে বিভাগের করিডোরে দেখা হলেও ছেলেটির সাথে আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি পরিচয় ছিল না। সে যাই হোক। আমি মেসেজের উত্তরে মেসেজ না দিয়ে ছেলেটিকে কল করলাম। তাকে পরদিন একটা অবসর সময়ে আমার চেম্বারে আসতে বললাম।
আমাদের সাক্ষাতে সে আমার কাছে যে বিষয়ে জানতে চাইলো তার সারাংশ হলো, আর মাস খানেক পরেই তার আইনে স্নাতক সম্পন্ন হবে। পরিবার আর বড়জোর এক বছর তার খরচ বহন করবে, এরমধ্যে তাকে কিছু একটা করতেই হবে। এখন সে কী করবে বা কী করা উচিত তা ভেবে পাচ্ছে না, তাই সে আমার সাথে পরামর্শ করতে এসেছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যে আইনে স্নাতক করছেন তা কী নিজের ইচ্ছায় না অন্যের ইচ্ছায়? সে জানালো, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় নয়, এলাকার এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে সে আইনে ভর্তি হয়েছিল। সেই বড় ভাই তাকে বলেছিল, “আইন পাস করলে কাজের অভাব নেই, অনেক কিছুই করতে পারবে।” আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, অনেক পেশার মধ্যে, কোন পেশা তার পছন্দ? কী পেশাকে সে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে? সে বললো, কোনো পেশা পছন্দ করে সে তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারেনি। সে কারণেই সে আমার সাথে পরামর্শ করতে চায়। আমি তার সাথে অনেকক্ষণ আলোচনা করে তাকে একটি পেশা পছন্দের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলাম, তবে একটি কথা তাকে বলেছিলাম যে, হঠাৎ করে কারো জন্য একটি পেশা পছন্দ করা সহজ কাজ নয়। কারণ এক্ষেত্রে তার ভালোলাগা, পারিবারিক অবস্থা, একাডেমিক রেজাল্ট, পড়াশোনার আগ্রহ ও পরিশ্রম করার মানসিকতা সম্পর্কে জানতে হয়। জানতে হয়, এখন তিনি লেখাপড়ার কোন স্তরে রয়েছেন। সামগ্রিকভাবে এসব বিষয়ে না জেনে পরামর্শ দিলে, সে সব পরামর্শ গতানুগতিক হয়। আমি আমার আগের লেখাগুলোতেও বলেছি, আমাদের মধ্যে যারা আইনে পড়ি, কিছু সংখ্যক ছাড়া তাদের অধিকাংশই না জেনে, না বুঝে অন্যের প্ররোচনায় আইনে পড়ি। ছাত্র জীবনে গুটিকয়েক ছাত্র ছাড়া, অধিকাংশই পেশার ক্ষেত্রে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারিনা। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করে তারপর চিন্তা শুরু করি এখন আমি কী করব। আমার এই ছাত্রটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
বর্ণিত ছাত্রটি বিদায় নেওয়ার পর, আমি আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রথমদিকের দুজন শিক্ষার্থীর কথা স্মরণ করলাম। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়ে আসি তখন ওরা শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। এক বছর পরেই ওদের আইনে স্নাতক শেষ হয়েছিল। ওদের ব্যাচের টপার ছিল খুবই বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। সিজিপিএ ৪ এর মধ্যে প্রায় ৪ এর কাছাকাছি। মনে নেই, সে সম্ভবত চ্যান্সেলর বা ভাইস চ্যান্সেলর পদক পেয়েছিল। একদিন ক্লাসে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এত অসাধারণ রেজাল্ট, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? কোন পেশায় যেতে চাচ্ছেন? তার অতি সাবলীল উত্তর, স্যার এখনও কিছু ভাবি নি, আগে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন হোক, তারপরে ভাববো। পরবর্তীতে তার বন্ধুদের মাধ্যমে জেনেছি, সে প্রথমবার বার কাউন্সিলের এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি, পারেনি জুডিসিয়ারির প্রথম ধাপ পার করতে। অথচ এসব পরীক্ষাগুলো হয়েছিল তার স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার প্রায় দুই বছর পরে। তার এই অনুত্তীর্ণের জন্য আমার একবারও মনে হয়নি সে কম মেধাবী। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তার এই অনুত্তীর্ণের কারণ হলো অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং জীবনের কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ না করা। হয়তো সে ভেবেছে, আমি ক্লাসের টপার,কখনও দ্বিতীয় হইনি, বার কাউন্সিল বা বিজিএসএর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা তেমন কিছুই না, অথবা এগুলোর কোনোটিই তার লক্ষ্য না থাকার কারণে তেমন গুরুত্ব না দেওয়া। তার মতো একজন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীর এসব পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণের ঘটনা, সত্যিই আমাকে হতাশ করেছিল। পরে অবশ্য সে সফল হয়েছে।
এর বিপরীত ঘটনাও আছে, ওদের ব্যাচেরই একজন ছাত্র। সিজিপিএর ভিত্তিতে সে শেষ থেকে প্রথম। ক্লাসে কিছুটা অনিয়মিত, সকালের প্রথম ক্লাস হলে প্রায়ই সে দেরি করে ফেলতো। মিড-টার্ম পরীক্ষার যেদিন খাতা দেখাই, খাতার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার সিজিপিএ কত? তার উত্তর শুনে আমি ভড়কে গেলাম। এত কম সিজিপিএ কারো হয় নাকি? আমি নিশ্চিত হতে আবারও জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক বলছেন না ভুল বলছেন? ওর সহপাঠীরা নিশ্চিত করল, ও ঠিকই বলেছে। জানতে চাইলাম, এই রেজাল্ট দিয়ে কী করবেন? আপনার জীবনের লক্ষ্য কী? তার সরল স্বীকারোক্তি, স্যার আমি অ্যাডভোকেট হব। অ্যাডভোকেট হতে বেশি সিজিপিএ লাগে না, ভালো থাকলে ভালো না থাকলেও সমস্যা নেই। তখন আমি নিজেও অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হইনি। তাই এ বিষয়ে আমারও স্বচ্ছ ধারণা ছিল না, তাকে বলছিলাম এই সিজিপি দিয়ে অ্যাডভোকেট হতে পারবেন? সে বলেছিল, ইন্টিমেশন জমা দিতে পারলে সে অ্যাডভোকেট হতে পারবে। সে অ্যাডভোকেটই হতে চায়, অন্য কোনো পেশায় তার আগ্রহ নেই। আমি খেয়াল করলাম, তার এই আত্মবিশ্বাস দেখে ওর বন্ধুরা মিটিমিটি করে হাসছিল। আমি ক্লাসে আর তার সাথে এ বিষয়ে কথা বাড়াইনি। সম্ভবত সে তার বন্ধুদের সাথে স্নাতক শেষ করতে পারেনি, এক বা দুই সেমিস্টার পরে স্নাতক শেষ হয়। এরপর সে ইন্টিমেশন জমা দিয়ে বার কাউন্সিলে তার প্রথম পরীক্ষায়ই উত্তীর্ণ হয়ে তিনটি ধাপ পার করে অ্যাডভোকেট হয়ে যায়। আমার দিব্যি মনে আছে, বার কাউন্সিল যেদিন চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করল, সে ফলাফল পেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিল “আলহামদুলিল্লাহ, অ্যাডভোকেটশিট পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হলাম।অ্যাডভোকেট…(তার নাম)…. ” তার এই পোস্ট দেখে, ওর সহপাঠীরা ফোন দিয়ে ওকে বলেছে অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে মজা করতে নেই। যেখানে আমাদের অধিকাংশ বন্ধুরাই প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি, সেখানে তুই পাস করলি কীভাবে। স্ট্যাটাস ডিলিট করে ফেল। ওর বন্ধুদের সাথে কথা হলে ওরা এখনো বলে, ও যে প্রথমবারে অ্যাডভোকেট হয়েছে, এটা আসলে কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। পরে যখন আইনজীবী সমিতির সদস্য পদ নিয়ে, আইডি কার্ড ও সার্টিফিকেট দেখালো তখন সবাই নিশ্চিত হয়েছে।
ওর অ্যাডভোকেট হওয়া টা আমার কাছেও বিস্ময় লেগেছিল। এটা কী করে সম্ভব হলো। পরে অবশ্য ওর কাছ থেকেই নিশ্চিত হয়েছি, ওর জীবনের লক্ষ্যই ছিল অ্যাডভোকেট হওয়া। সেজন্যই সে আইনে ভর্তি হয়েছে। সে আগে থেকেই খোঁজখবর নিয়েছিল যে, অ্যাডভোকেট হতে হলে খুব বেশি সিজিপিএ দরকার হয় না। এ কারণে সে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে রেজাল্টের জন্য মরিয়া ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল,শুধু একটা সার্টিফিকেট হলেই হলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ছেলেটি ছাত্র জীবনেই তার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারার কারণে, কম সিজিপিএ নিয়েও খুব সহজে বার কাউন্সিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এই ঘটনার মাধ্যমে আমি কাউকেই কম সিজিপিএ অর্জনের জন্য প্রলুব্ধ করছি না। সিজিপিএ অর্জন করুন, তবে জীবনের লক্ষ্যটাও নির্ধারণ করুন, তাহলে জীবনে সফলতা খুব দ্রুতই আসার সম্ভাবনা থাকে। তবে এর ব্যতিক্রম যে হয় না তা নয়। অনেকেই শুরুতে জীবনের স্বপ্ন ও লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম দিকের মেধাক্রমে থেকেও সহজ বিষয়ে পড়াশোনা করে, যাতে তার একাডেমিক পড়াশোনা লক্ষ্য অর্জনে বাধাগ্রস্ত না হয়। এবং তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হয়। তাই উপরিউক্ত আলোচনা থেকে, আমার এটাই মনে হয়, ছাত্র জীবনে, জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে না পারা আইনের ছাত্রদের জন্য একটি বড় ভুল। আমার মতে, একদম শুরুতে না পারলেও প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করতে করতে জানাশোনা মানুষের সাথে পরামর্শ করে জীবনের লক্ষ্যটা নির্ধারণ করে নেওয়া উচিত। হয়তো বিকল্প লক্ষ্য থাকতে পারে, তারপরেও একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে ছাত্র জীবনেই সেভাবে লেখাপড়া করা উচিত। তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আইনে পড়ুয়ারা কর্মজীবনে পিছিয়ে যাবেন না।
আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি, জীবনের লক্ষ্য কেমন হওয়া উচিত তার একটি উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করি। আমরা হিন্দু পুরাণ মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের নাম জানি, এরা হলেন যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। পঞ্চপাণ্ডবরা গুরুদেব দ্রোণাচার্যের নিকট ধনুর্বিদ্যার জ্ঞান অর্জন করতে শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। একদিন গুরু দ্রোণাচার্য শিষ্যদের পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবলেন। এরপরের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন, তিনি শিষ্যদেরকে বনে নিয়ে একটি গাছের দিকে ইশারা করে বললেন, “ওখানে দেখ, ওই গাছে একটা নকল পাখি ঝুলছে। আমি চাই সবাই একে একে পাখিটির চোখের দিকে তীর তাক করো এবং তীরটি সোজা চোখের মাঝখান দিয়ে চলে যাক।” পঞ্চপাণ্ডবের একের পর একজন আসতে লাগলেন, দ্রোণাচার্য তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, বৎস কী দেখতে পাচ্ছো? প্রায় সকলেরই উত্তর এরকম ছিল “গুরুদেব আপনি, আপনার ভাই, এই বন, গাছপালা, গাছের পাতায় বসে থাকা পাখি, সবই দেখছি।” গুরুদেব তাঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই বললেন তোমরা এখনও এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত নও।
সবশেষে শুরু হলো অর্জুনের পালা। গুরুদেব তাঁকে ডেকে তাঁর হাতে তীর-ধনুক ধরিয়ে দিলেন। তারপর তিনি অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, “বৎস, বল কী দেখছ?” অর্জুন বললেন, “আমি সেই পাখির চোখ দেখতে পাচ্ছি গুরুদেব।” গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন, “আর কি দেখছো, অর্জুন?” অর্জুন বললেন, “পাখির চোখ ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” অর্জুনের কথা শুনে দ্রোণাচার্য হেসে বললেন, “তুমিই এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত। লক্ষ্যে আঘাত করো।” গুরুর নির্দেশ পেয়ে অর্জুন পাখির চোখে তীর নিক্ষেপ করেন এবং তীরটি সোজা তার লক্ষ্য ভেদ করে চলে যায়। মহাভারতের এই গল্পটি আমাদের শিক্ষা দেয়, জীবনে লক্ষ্যকে এমন ভাবে নির্ধারণ করুন, যাতে আপনি শতভাগ আপনার লক্ষ্যে মনোনিবেশ করতে পারেন। লক্ষ্য নির্ধারণ না করা অথবা আজ এটা তো কাল ওটা, এভাবে প্রতিনিয়ত লক্ষ্য পরিবর্তন করলে জীবনে সহজে সফলতা অর্জন করা বাস্তবে কঠিন। সকলের জন্য শুভকামনা রইল। (চলবে)।
লেখক:
আরিফুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ;
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, (বিইউবিটি)।
Leave a Reply